জুয়েলারি শিল্পের যেমন বিশ্বজুড়ে সমাদর রয়েছে, তেমনি আমাদের দেশেও সমাদৃত হওয়া সত্ত্বেও যুগের পরিক্রমায় অবহেলিত হয়ে বেঁচে আছে। এই সেক্টর যতটুকু ডানা মেলেছে তার সবটুকুর দাবিদার ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান। দেশের ৬৪ জেলায় যেভাবে ছোট বড় জুয়েলারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সবটুকুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক সফলতার প্রতীকই বহন করছে। জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা দেশে ব্যবসার সূচনালগ্ন থেকেই ক্রেতা সাধারণের কাছে গচ্ছিত সোনা রিসাইকেলিং ও বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে ব্যাগেজ রুলের আওতায় প্রাপ্ত সোনা দিয়ে অদ্যাবধি তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখছে। আজ এই স্বর্ণ খাত দেশ ও জাতির সম্পদে পরিণত হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ব্যবসার অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করার লক্ষ্যে স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করেন, যা ২০১৮ সালে প্রণীত এবং ২০২১ সালে সংশোধন করা হয়। স্বর্ণ মূল্যবান ধাতু, যার সঙ্গে শুধুই তুলনা করা হয় মুদ্রার। কিন্তু এটাকে যদি পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়, তবে এই স্বর্ণ হতে পারে দেশের সর্ববৃহৎ খাত। পণ্য হিসাবে স্বর্ণকে নির্ধারণ করে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গহনায় রূপান্তরিত করে রফতানির সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। তবে এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ আসবে; যা জিডিপিতে বিশাল অবদান রাখবে।
আমরা যদি ভারতের সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করি, দেখা যাবে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভারত মোট স্বর্ণালংকার রফতানি করেছে ৩৯ হাজার ৩৩১ দশমিক ৭১ মার্কিন মিলিয়ন ডলারের। যা এখন আরও বেড়েছে।
তিন দশক আগে বিশ্বের মোট চাহিদার ৪৫ শতাংশ ছিল এশিয়াতে, বর্তমানে এশিয়াতে স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬০ শতাংশ। চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিত্র বদলাতে ভূমিকা রেখেছে এই স্বর্ণ খাত।
বর্তমানে ভোক্তার চাহিদার সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। ১৯৯২ সালে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ৩০০ মার্কিন ডলার। সেই স্বর্ণ ২০২৩ সালে এসে সর্বোচ্চ দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২০৪১ দশমিক ১০ মার্কিন ডলারে।
অন্যদিকে ১৯৯২ সালে স্বর্ণের বার্ষিক উৎপাদন ছিল ২ হাজার ২৭০ টন আর ২০২২ সালে এসে উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬১২ টনে এবং ক্রমান্বয়ে উৎপাদিত স্বর্ণের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ফলে গত ৩০ বছরে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে স্বর্ণ স্থিতিশীল মূল্যবান সম্পদ হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
বাজুসের পরিসংখ্যান থেকে আমরা জানি, বাংলাদেশে কম-বেশি ৪০ হাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছেন, যারা প্রত্যক্ষভাবে এই স্বর্ণ ব্যবসায় জড়িত। প্রতিদিন যদি একজন ব্যবসায়ী এক ভরি করে স্বর্ণ ব্যবহার/বিক্রি করেন, তবে বছরে দেশের স্বর্ণের চাহিদা আছে ১৬৭ দশমিক ৮৭ টন। যার বর্তমান বাজার মূল্য আছে এক লক্ষ ২৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকা বা ১২ হাজার ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদি এই ব্যবহার/বিক্রির পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেশি হয় তবে স্বর্ণের চাহিদা হবে ২৫১ দশমিক ৮০৫ টন এবং এর বাজার মূল্যও সে হারে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেসব পণ্য আমদানি হয় তার মূল্য বিনিময়ও হয় এই স্বর্ণের মাধ্যমে, যা অঘোষিত সত্য। যার ৮০ শতাংশই হয়ে থাকে অবৈধ পথে। এর ফলে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে। এর সমাধানকল্পে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন দেশের স্বর্ণ খাতে বিদ্যমান প্রচলিত আইনের।
পরিবর্তন প্রয়োজন ব্যাগেজ রুলের। এক্ষেত্রে একজন যাত্রী ব্যাগেজ রুলের সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে যে টাকার স্বর্ণ নিয়ে আসছে, সেই পরিমাণ বৈধ টাকা তার ট্যাক্স ফাইলে আছে কিনা তার তদারকি করা প্রয়োজন। একজন বিদেশফেরত যাত্রী কতদিন বিদেশে অবস্থান করলে ট্যাক্সবিহীন সে কী পরিমাণ স্বর্ণ সঙ্গে আনতে পারবে তারও একটা নীতিমালা প্রয়োজন। এখনই সময় দেশ উন্নয়নে এই স্বর্ণ খাতকে সুযোগ করে দেওয়া, যাতে এটা হতে পারে দেশের গর্ব করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল খাত।
ভারত, চীন ও রাশিয়ার দিকে যদি দৃষ্টিপাত করা যায় দেখা যাবে তারা অন্যান্য রফতানি খাতের উন্নতির সঙ্গে স্বর্ণ খাতকে বিশেষ অবস্থানে রেখেছে। এর ফলে আজ ভারতের স্বর্ণ মজুতের পরিমাণ ৭৮৭ টন। চীনের মজুতের পরিমাণ ২ হাজার ১১ টন। রাশিয়ার স্বর্ণ মজুতের পরিমাণ ২ হাজার ২২৯ টন। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বর্ণ মজুতের পরিমাণ ১৪ দশমিক ৩০ টন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে মজুত আছে ৩৫ হাজার টনেরও বেশি স্বর্ণ। বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে যদি আমরা তাল মিলিয়ে চলতে না পারি, তবে পিছিয়ে পড়বে দেশের আয়ের উৎস।
অন্যদিকে আমাদের দেশে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বর্ণের দাম অনেক বেশি। কারণ, এই স্বর্ণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চোরাচালান চক্র। তাই ক্রেতা সাধারণের একটা বিরাট অংশ পার্শ্ববর্তী দেশ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে স্বর্ণ কিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর প্রধান কারণ আইনবহির্ভূতভাবে দেশে স্বর্ণ আসছে এবং চোরাচালান চক্রের নিজেদের প্রয়োজনে স্বর্ণের দাম বাড়িয়ে রেখে আর্থিক ফয়দা লুটছে। যার প্রভাব পড়ছে দেশের ক্রেতা সাধারণের ওপর। এর ওপর দেশের আয়ের উৎস ভ্যাট/ট্যাক্সের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে অনেক বেশি।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভারতে এই ভ্যাটের (জিএসটি) পরিমাণ স্বর্ণালংকারের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ ও ডায়মন্ডের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ। কিন্তু আমাদের দেশে এর পরিমাণ ৫ শতাংশ। তাই বর্তমান বিশ্বে স্বর্ণের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের ক্রেতারা বহির্বিশ্ব থেকেই স্বর্ণ ক্রয়ে বেশ উৎসাহী। কারণ, বাংলাদেশে ১০ ভরি স্বর্ণ কিনতে যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন তার থেকে ১৫ শতাংশ কম দামে ক্রেতারা দেশের বাইরে থেকে স্বর্ণ কিনতে পারেন। এর ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশের ব্যবসায়ীরা হারাচ্ছেন তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি আর দেশ হারাচ্ছে রাজস্ব। এভাবে চলতে থাকলে এই খাতে নতুন বিনিয়োগে বাড়বে হতাশা। তাই এই সম্ভাবনার বিনিয়োগ ক্ষেত্র বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজন স্বর্ণালংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কমিয়ে ৩ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা। এতে ভ্যাট আদায় কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।
সর্বোপরি এই স্বর্ণ খাতকে উন্নয়নের হাতিয়ার বানাতে প্রয়োজন আমদানি ও রফতানি প্রক্রিয়া সহজকরণ। দেশের স্বর্ণশিল্পের চাহিদা পূরণ করার স্বার্থে গোল্ড রিফাইনারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সর্ব প্রথম সোনা পরিশোধনাগার স্থাপন করতে যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে কিছু দিন পর রফতানি হবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সংবলিত সোনার বার, যা আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণে বড় ভূমিকা পালন করবে। এটি একটি ভ্যাট নিবন্ধনকারী শিল্প এবং একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল শিল্প। স্বর্ণ আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার উদ্দেশ্যে আইআরসিধারী এবং ভ্যাট কমপ্লায়েন্ট শিল্পের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক শর্তসাপেক্ষে অপরিশোধিত স্বর্ণ আকরিকের ক্ষেত্রে সিডি ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১ (এক) শতাংশ নির্ধারণ করা, আংশিক পরিশোধিত সোনার ক্ষেত্রে সিডি ১০ শতাংশের পরিবর্তে আইআরসিধারী এবং কমপ্লায়েন্ট শিল্পের জন্য শুল্ক হার ৫ শতাংশ করা।
পাশাপাশি এই পরিশোধনাগারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির শুল্ক কর ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তাই দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে এর হার কমানোর সঙ্গে সোনার অলংকার প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মেশিনারিজের ক্ষেত্রে সব ধরনের শুল্ক কর অব্যাহতি প্রদানসহ ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ বা ট্যাক্স হলিডে প্রদান করা যেতে পারে।
রফতানিকে উৎসাহিত করতে এবং যাতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সম্ভাবনাময় শিল্প খাত দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করা ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে ও জিডিপিতে অবদান রাখতে পারে, তার নিমিত্তে স্বর্ণ আমদানি রফতানি প্রক্রিয়া সহজ করা। ভারত ও দুবাই চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে স্বর্ণ আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে কোনও শুল্কায়ন থাকবে না। এর ফলে ভারত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তাদের রিজার্ভে যোগ করছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশও যদি স্বর্ণ আমদানি ও রফতানির এই সহজ দ্বার খুলে দিতে পারে তবে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ অন্তত ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাণিজ্যের সম্ভাবনাময় দেশে পরিণত হবে।
দেশের সম্ভাবনাময় এই খাতকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে প্রয়োজন এইচএস কোডভিত্তিক অস্বাভাবিক শুল্ক হার-সমূহ হ্রাস করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শুল্ক হার সমন্বয়সহ এসআরও সুবিধা প্রদান করা।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০২২ ধারা-১২৬ ক অর্থ আইন ২০১৯ (২০১৯ সালের ১০নং আইন)-এর ১০২ ধারা বলে, চোরাচালান প্রতিরোধ করতে গিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদ্ধারকৃত সোনার মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ সংস্থাসমূহের সদস্যদের পুরস্কারস্বরূপ প্রদান করা ও আমদানি-রফতানি নীতিমালা সহজ করার মাধ্যমে চোরাচালান প্রতিরোধ করে ঢাকার তাঁতীবাজার কেন্দ্রিক চোরাচালান চক্র বহির্বিশ্বের দামের সঙ্গে তাদের লভ্যাংশ যোগ করে স্বর্ণের দাম বাড়িয়ে রেখে মনোপলি ব্যবসা করে একদিকে যেমন অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অন্যদিকে স্বর্ণ ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের রাজস্বকেও সংকুচিত করছে। এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করতে পারলেই দেশ রূপান্তরিত হবে সোনার বাংলায়।
লেখক: সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুস