সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সোনা চোরাচালান চক্র। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা চোরাচালানের সোনা নিরাপদে সীমান্ত পথে পাচার হচ্ছে। এই সোনা চোরাকারবারিদের ভয়ংকর সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারাও জড়িত। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ও বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সীমান্ত এলাকাগুলোতে চোরাচালানের সোনা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। তথ্য : সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুসের সাবেক সভাপতি ও সংগঠনটির এন্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান এনামুল হক খান দোলন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে যে পরিমাণ সোনা চোরাচালান হয়, তার ১ শতাংশও ধরা পড়ে না। যে পরিমাণ চোরাচালানের সোনা ধরা পড়ে, তা সমুদ্রের এক বিন্দু জলের সমান। এ যাবৎ সোনাসহ যত ব্যক্তি ধরা পড়েছেন, তার অধিকাংশের বিচার হয়নি।
বাজুস নেতা আরও বলেন, সরকারের কঠোর নীতিমালা ছাড়া সোনা চোরাচালান বন্ধ হবে না। কারণ, সোনা চোরাচালানের যে তথ্য আমরা গণমাধ্যম থেকে পাচ্ছি, তাতে এটা স্পষ্ট যে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা এই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকার লোকজন সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। মুনাফা যত বাড়বে, দেশে সোনা চোরাচালানও তত বাড়বে বলে মনে করেন বাজুসের সাবেক এই সভাপতি।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মোবারা খানম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত দুই বছরে যে পরিমাণ চোরাচালান উদঘাটিত হয়েছে, সেই পরিমাণ চোরাচালান গত দুই মাসে চিহ্নিত করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। এর মধ্যে গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি চোরাচালানের সোনা উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা।
শুল্ক গোয়েন্দার পরিসংখ্যান বলছে, গত আড়াই বছরে শুধু বাংলাদেশ বিমানেই প্রায় ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের আড়াই শ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সাজা হয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির। এখনো চলমান আছে অনেক মামলা।? শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থাটিতে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। সোনা চোরাচালানের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকেই বেছে নিয়েছেন পাচারকারীরা। প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেও সোনা চোরাচালানকারীদের সহায়তা ও সোনা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সোনা চোরাচালানের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে ১২ পিস সোনার বারসহ মিজান উদ্দিন নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে আসা এক যাত্রীকে গত ২২ জুলাই আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। আটক হওয়া সোনার বারের বাজারমূল্য প্রায় ৯০ লাখ টাকা। এদিকে গত ২১ জুলাই রাতে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁর গুনারমাঠ ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা ৩২১টি সোনার বিস্কুট, চারটি সোনার বার ও একটি সোনার কয়েন জব্দ করেছে। উদ্ধার হওয়া সোনার ওজন ৪১ কেজি ৪৯১ গ্রাম। যার বাজার মূল্য প্রায় ২১ কোটি ২২ লাখ ভারতীয় রুপি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের গুনারমাঠ এলাকায় ইছামতি নদীর ধার দিয়ে পাচারকারীরা এই সোনা পাচারের চেষ্টা করছিল। ঘটনার সময় বিএসএফ সদস্যরা পাচারকারীদের তাড়া করে এই বিপুল পরিমাণ সোনা জব্দ করেন। সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে চোরাচালান করা পণ্যের শীর্ষে আছে সোনা। দামের পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা চোরাচালান সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সোনা চোরাচালান হয় সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা দিয়ে। ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ ২০২০ সালে ৩৩ কেজি সোনা উদ্ধার করে। ২০২১ সালে কভিড মহামারির মধ্যেও ৩০ কেজি সোনা উদ্ধার করেছে। তবে চলতি ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত, এই ৬ মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ৩৩ কেজি সোনা উদ্ধার করেছে। ভারত থেকে পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসা ট্রাকগুলো খালি ফিরে যায়। সেগুলো থেকেও কিছু সোনা সাম্প্রতিক সময়ে জব্দ করেছে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী। সোনা চোরাচালান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, সোনা চোরাচালান কমেনি। সোনা চোরাচালান বন্ধ করা বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য নয়, লেনদেন মাধ্যম হিসেবেও সোনা চোরাচালান করা হয়। সোনা চোরাচালানে ভাটা পড়েনি কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া দরকার। সম্পূর্ণভাবে সোনা চোরাচালান বন্ধ করা যাবে কি না, তা জানি না। নানাভাবে চোরাচালান হয়, এটিই বাস্তবতা। সারা বিশ্বেই এটি হয়। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। এদিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১ কেজি ৩৩৬ গ্রাম সোনাসহ যাত্রী নুর হোসেনকে গত ২৫ জুন আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা। এদিন সকালে দুবাই-ঢাকা রুটের এমিরেটস এয়ারলাইনসের ইকে-৫৮২ ফ্লাইটে আসা ওই যাত্রীকে আটক করা হয়। ভারতে পাচারের সময় ১০টি সোনার বারসহ মনিরুজ্জামান (৪০) নামে এক পাচারকারীকে আটক করে যশোর ৪৯ বিজিবি সদস্যরা। গত ১৯ জুন যশোরের শার্শা উপজেলার নাভারন এলাকা থেকে এসব সোনার বারসহ মনিরুজ্জামানকে আটক করা হয়। বিজিবি জানিয়েছে, সোনা পাচারকারী ঢাকা থেকে ১০টি সোনার বার নিয়ে ভারতে পাচারের জন্য বেনাপোলের দিকে যাচ্ছিল। নাভারন বাজারে গাড়ি থামিয়ে মনিরুজ্জামানকে তল্লাশি করে ১০টি সোনার বার পাওয়া যায়।
অন্যদিকে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সোনা চোরাচালানের রুট হয়ে উঠেছে। গত আট বছরে ওসমানী বিমানবন্দরে ১১২ কেজির বেশি সোনা আটক করেছে কাস্টমস বিভাগ। যার দাম ৭৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। সোনা উদ্ধার হলেও মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে চোরাকারবারিরা দেশে আনছে সোনা। জানা গেছে, গত ২৭ মে চিকিৎসাসামগ্রী নেবুলাইজারের মধ্যে ঢুকিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে ১১টি সোনার পাত এনে বিমানবন্দর অতিক্রম করার সময় কাস্টমসের হাতে ধরা পড়েন দুবাই প্রবাসী আলী আহমদ। জব্দ সোনার পরিমাণ ১ কেজি ১৬০ গ্রাম। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকেই অধিকাংশ সোনা জব্দ করা হয়। চোরাকারবারিরা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে দেশে সোনা আনছে।
এর আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ময়লার পলিথিনের মধ্যে থাকা ৮ কেজি ১২০ গ্রাম ওজনের সোনার বার গত ৩০ এপ্রিল উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস। যার আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোনার বারসহ মো. আরিফ নামের বাহরাইন প্রবাসীকে গত ১২ এপ্রিল আটক করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস। এই প্রবাসীর মুঠোফোনের কেসিং থেকে ৬ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনার বার উদ্ধার করা হয়।