আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সোনা আমদানি ও জুয়েলারিশিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।
অসম শুল্ক কাঠামো, প্রাথমিক কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক ব্যয় ও সঠিক নীতিমালার অভাবে বেকায়দায় রয়েছে সম্ভাবনাময় স্বর্ণশিল্প। অথচ দেশে সঞ্চয় ও ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম স্বর্ণশিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ আছে।
বর্তমানে অপরিশোধিত সোনা আমদানিতে ৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (সিডি), ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), ৫ শতাংশ আগাম করসহ (এটি) মোট ৩১ শতাংশ কর দিতে হয়। অন্যদিকে প্রাক-বাজেট আলোচনায় বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) এই করহার কমিয়ে ২৬.২ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে ১ শতাংশ সিডি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ এআইটি ও ৫ শতাংশ এটি।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশের স্থানীয় বাজারে সোনার দাম প্রতি ভরিতে (১১.৬৬৪ গ্রাম) ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা বেশি, যার অন্যতম কারণ কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে অসহনীয় শুল্কহার।
গতকাল শনিবারের হিসাব অনুযায়ী দুবাইয়ে ২২ ক্যারেটের এক গ্রাম সোনার দাম ২৬১.৭৫ দিরহাম। আর এক দিরহামে পাওয়া যায় ৩২.১২ বাংলাদেশি টাকা। সে হিসাবে দুবাইয়ে এক ভরি সোনার দাম পড়ছে ৯৮ হাজার ৬৪ টাকা। অন্যদিকে ভারতের বাজারে একই দিন প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল এক লাখ ৫৪৮ টাকা।
বিপরীতে দেশের বাজারে সোনার দাম এক লাখ ১৮ হাজার ৪৬০ টাকা।
এতে অলংকারের দাম বেশি পড়ায় দেশের ক্রেতারা বিদেশ থেকে সোনা কেনায় বেশ উৎসাহী। কারণ বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম দামে ক্রেতারা দেশের বাইরে থেকে সোনা কিনতে পারেন। এভাবে দেশের সম্ভাবনাময় জুয়েলারিশিল্প খাতের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুল্কহার।
ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এতে দেশের ব্যবসায়ীরা হারাচ্ছেন তাঁদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি আর দেশ হারাচ্ছে রাজস্ব। এভাবে চলতে থাকলে এই খাতে নতুন বিনিয়োগে হতাশা বাড়বে।
ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা নিজস্ব প্লান্টের মাধ্যমে পরিশোধন করা হলে দেশ শিল্পায়নের নতুন খাতে প্রবেশ করবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রযুক্তি আহরণসহ দক্ষ জনবলের সৃষ্টি হবে। দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সোনার বার রপ্তানিও সম্ভব হবে, যার ফলে রপ্তানি পণ্যে নতুন বৈচিত্র্য তৈরি হবে। নিজস্ব প্লান্টে বাণিজ্যিকভাবে পরিশোধন শুরু না হওয়ায় শিশু শিল্প হিসেবে আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে কমিশন।
ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অন্যান্য শিল্পের মতো জুয়েলারিশিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি সর্বনিম্ন শুল্কে আমদানির সুযোগ দিলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে রেয়াতি শুল্ক দিয়েছে এনবিআর। সে ক্ষেত্রে জুয়েলারিশিল্পের এই সুবিধা পেতে শিল্পসংশ্লিষ্ট এইচএস কোড সংযোজন করে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পারে। এ ছাড়া সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন (ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস) না থাকায় বিক্রয়মূল্যে তারতম্য দেখা যাচ্ছে। এই জটিলতা নিরসনে সব প্রতিষ্ঠানে দ্রুত ইএফডি মেশিন সরবরাহ করা যেতে পারে।
নিজস্ব প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে পরিশোধন শুরুর আগে অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনার ওপর যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক কমানো, অন্যান্য শিল্পের মতো জুয়েলারিশিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি সর্বনিম্ন শুল্কে আমদানির সুযোগ এবং সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে দ্রুত ইএফডি মেশিন সরবরাহের সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন।
জানতে চাইলে বাজুসের ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অবৈধভাবে সোনা আসে। এ জন্য বিশ্ববাজার বা পাশের দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে শুল্কহার নির্ধারণ করা উচিত, যাতে সোনা চোরাচালান কম হয়। শুল্কমুক্ত আমদানি করার প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। সোনা আমদানি করে বিশ্ববাজারের দরে রপ্তানি করতে হলে শুল্কহার অবশ্যই যৌক্তিক করতে হবে। বৈধভাবে আমদানির চেয়ে যদি অবৈধভাবে সোনা আনলে খরচ কম হয়, তাহলে বৈধ আমদানি নিরুৎসাহ হবে, চোরাচালান বৃদ্ধি পাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব রিফাইনিংয়ে যেতে চাই। কিন্তু এখানেও ট্যাক্স-ভ্যাট সব কিছু যাতে কমিয়ে রাখে, যেন বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে পারি। আমাদের দেশে শুল্কহার বেশি হওয়ায় পাশের দেশ ও অন্যান্য দেশ থেকে অমসৃণ হীরা আসছে। শুল্ক না কমালে দেশে কাটিং শিল্প প্রতিষ্ঠিত হবে না। শুল্কহার না কমালে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না।’
এর আগে এনবিআরে আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় বাজুসের পক্ষ থেকে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস সংক্রান্ত ১৫টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বাজুসের প্রস্তাবের ওপর পর্যবেক্ষণ করে ট্যারিফ কমিশন তাদের সুপারিশ এনবিআরকে পাঠিয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে এনবিআর কর্মকর্তারা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশনের মতো আমাদেরও পর্যবেক্ষণ আছে। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের যৌক্তিক সুপারিশ অবশ্যই মূল্যায়ন করা হবে।’